সীতাকুণ্ডে গতকাল জাপানের ক্লাসএনকের এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট ড. ইয়ামাগুচি এবং জাপান দূতাবাসের মিনিস্টার ও ডেপুটি চিফ অব মিশন তাকহাশি নাওকিসহ জাপানের একটি দল পিএইচপি ফ্যামিলির চেয়ারম্যান আলহাজ্ব সুফি মোহম্মদ মিজানুর রহমানকে কৃতিত্বের সনদ প্রদান করে। এ সময় উপস্থিত ছিলেন পিএইচপি ফ্যামিলির পরিচালক আলী হোসেন সোহাগ ও শিপ ইয়ার্ডের এমডি জহিরুল ইসলাম রিংকুসহ অতিথিরা - এস এম তামান্না
পিএইচপি শিপব্রেকিং অ্যান্ড রিসাইক্লিং ইন্ডাস্ট্রিজ দেশের প্রথম পরিবেশবান্ধব শিপইয়ার্ড। এটি ২০২০ সালে জাপানের আন্তর্জাতিক ক্ল্যাসিফিকেশন সোসাইটি ক্লাসএনকের মাধ্যমে হংকং কনভেনশনের স্বীকৃতি পায়। এরপর থেকে টানা পাঁচ বছর আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে প্রতিষ্ঠানটি দুর্ঘটনামুক্তভাবে জাহাজ রিসাইক্লিংয়ের কাজ করে আসছে, যা দেশের শিপ রিসাইক্লিং খাতের জন্য এক যুগান্তকারী অগ্রগতি।
গতকাল বৃহস্পতিবার হংকং কনভেনশনের স্বীকৃতি পাওয়ার পাঁচ বছর উদযাপন করে পিএইচপি ফ্যামিলি। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার ভাটিয়ারিতে পিএইচপি
শিপ রিসাইক্লিং ইয়ার্ডে আয়োজিত এই বিশেষ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন জাপানের শীর্ষ মেরিটাইম ও বাণিজ্য সংস্থার প্রতিনিধিরা। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন ক্লাসএনকের এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট ড. ইয়ামাগুচি। বিশেষ অতিথি ছিলেন ঢাকাস্থ জাপান দূতাবাসের মিনিস্টার ও ডেপুটি চিফ অব মিশন তাকাহাশি নাওকি। এ ছাড়া অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ, জাপান ও বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় শিপিং ও ট্রেডিং কোম্পানির মধ্যে এমওএল, এনওয়াইকে লাইন, কে লাইন, মিটসুই অ্যান্ড করপোরেশন ও জেএফই সোজি করপোরেশনের সিনিয়র কর্মকর্তারা অংশ নেন।
অনুষ্ঠানে পিএইচপি ফ্যামিলির চেয়ারম্যান আলহাজ¦ সুফি মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, বাণিজ্যিক সফলতার পাশাপাশি আমরা বিশ্বাস করি, টেকসই উন্নয়ন ও মানবিক দায়িত্ব একসঙ্গে এগিয়ে নিতে হয়। পাঁচ বছরের এই সম্মতির পথচলা আমাদের সেই দায়বদ্ধতার প্রতিফলন। আজকের এই মাইলফলক পরিবেশগত তত্ত্বাবধান, আন্তর্জাতিক সম্মতি এবং শ্রমের মর্যাদার প্রতি আমাদের অটল প্রতিশ্রুতি প্রতিফলিত করে। আমরা বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বিশ্বব্যাপী উদাহরণ স্থাপন করতে পেরে গর্বিত।
স্বাগত বক্তব্যে পিএইচপি শিপব্রেকিং অ্যান্ড রিসাইক্লিং ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. জহিরুল ইসলাম বলেন, গত এক দশকে অবকাঠামোগত উন্নয়ন, আধুনিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং পরিবেশ সম্মতির জন্য আমরা ১৪ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি বিনিয়োগ করেছি। বিশ্বখ্যাত এমওএল ও এনওয়াইকের জাহাজগুলো একটি দুর্ঘটনা ছাড়াই আমরা সফলভাবে রিসাইকেল করেছি। মতবিনিময় শেষে শ্রমিকদের নিয়ে ক্লাসএনকের মাধ্যমে হংকং কনভেনশনের সনদ অর্জনের পাঁচ বছরপূর্তি উদযাপন করেন অতিথিরা। পরে পিএইচপির শিপইয়ার্ড পরিদর্শন করেন তারা।
পরিদর্শন শেষে ড. ইয়ামাগুচি বলেন, বর্তমানে জাহাজ ভাঙা ও পুনর্ব্যবহারযোগ্য শিল্পে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, যা আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হচ্ছে। বিশেষ করে হংকং কনভেনশনের মতো আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বাস্তবায়নের মাধ্যমে এ খাতটি একটি টেকসই শিল্পে রূপান্তরিত হচ্ছে, যা ভবিষ্যতে বাংলাদেশকে এই খাতে বৈশ্বিক নেতৃত্বে নিয়ে যেতে পারে।
পিএইচপি শিপইয়ার্ডটি সবুজ পরিবেশ, পরিচ্ছন্নতা ও কার্যক্রমের টেকসই ব্যবস্থাপনা দেখে সন্তোষ প্রকাশ করেন ঢাকাস্থ জাপান দূতাবাসের মিনিস্টার তাকাহাশি নাওকি। তিনি বলেন, টেকসই সামুদ্রিক কার্যক্রমের উন্নয়নে বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যে বিদ্যমান সহযোগিতা আরও গভীর ও ফলপ্রসূ অংশীদারত্বে রূপ নিচ্ছে। জাহাজ পুনর্ব্যবহার, নৌ-নিরাপত্তা, পরিবেশ সংরক্ষণ এবং দক্ষতা উন্নয়নের মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে এই অংশীদারত্ব টেকসই উন্নয়নের আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিত করতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে বলে জানান তিনি।
এ সময় হংকং কনভেনশন বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা নিয়ে বিস্তারিত কথা বলেছেন পিএইচপি শিপব্রেকিং অ্যান্ড রিসাইক্লিং ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. জহিরুল ইসলাম। তিনি বলেন, হংকং কনভেনশন অনুযায়ী শিপ ইয়ার্ডগুলোকে একটি নির্দিষ্ট মান রক্ষা করা বাধ্যতামূলক। এই মানে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ সরকারের অনুমোদিত ১৩টি ইয়ার্ড। তবে অন্যান্য ইয়ার্ডগুলো এখনও পিছিয়ে।
তিনি বলেন, যারা হংকং কনভেনশন মানে পৌঁছাতে পারেনি, তাদের আর্থিক সহায়তা দরকার। আমরা সরকার, শিল্প মন্ত্রণালয় ও শ্রম মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করছি, যেন এসব ইয়ার্ডকে দীর্ঘমেয়াদি লোন দিয়ে পুনর্গঠন সম্ভব হয়। বিদেশি ডোনার ও বাংলাদেশ ব্যাংক এতে হযোগিতা করলে এই খাত আরও শক্তিশালী হবে।
গ্রিন হয়েও ‘লাল’ তালিকায় : বর্তমানে যেসব ইয়ার্ড আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন পরিবেশবান্ধবভাবে কাজ করছে, তারাও চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে। জহিরুল ইসলাম বলেন, আমরা ১০০-১৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে গ্রিন ইয়ার্ড গড়ে তুলেছি। তবুও পরিবেশ অধিদপ্তর এখনও আমাদের লাল ক্যাটাগরিতে রেখেছে। এতে বিদেশি ডোনাররা অর্থায়নে আগ্রহী হলেও, বাংলাদেশ সরকারের এই শ্রেণিকরণ তাদের থমকে দিচ্ছে। আমরা বলেছি, পরিবেশ অধিদপ্তর এসে দেখুক আমরা কী কাজ করেছি। আমরা চাই একসঙ্গে এই শিল্পকে এগিয়ে নিতে।
বর্তমান ডলার সংকটকেও জাহাজ ভাঙা শিল্পের বাধা হিসেবে চিহ্নিত করে জহিরুল ইসলাম বলেন, পাচার হওয়া বৈদেশিক মুদ্রা দেশে ফিরে আসতে হবে অথবা রেমিট্যান্স কিংবা এক্সপোর্ট বাড়াতে হবে, তাহলেই ডলার সংকট কেটে আসবে। আমাদের গার্মেন্টস এক্সপোর্ট কমেছে, সব সূচকে আমরা এখন নিম্নমুখী। এতে শিল্পে বিনিয়োগের গতি কমে গেছে।
শ্রমিক নিরাপত্তা ও প্রশিক্ষণে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের কথা জনিয়ে তিনি বলেন, শ্রমিকের নিরাপত্তা ইস্যু গুরুত্বপূর্ণ। আমরা শ্রমিকদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও পারসোনাল প্রটেকটিভ ইকুইপমেন্ট সরবরাহ নিশ্চিত করতে সচেষ্ট। পিএইচপি ২০২০ সালে ক্লাসএনকের কাছ থেকে হংকং কনভেনশন সনদ অর্জন করার পর টানা পাঁচ বছর কোনো দুর্ঘটনা ছাড়াই কাজ করেছে। যা একটি মাইলফলক বলে আখ্যা দেন পিএইচপি শিপ ইয়ার্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
জাহাজ ভাঙা শিল্পে বাংলাদেশের সক্ষমতার কথা জানিয়ে জহিরুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশের ইয়ার্ডগুলো অনেক বড়। আমাদের এখানে একসঙ্গে ৫-৬টি জাহাজ আনা সম্ভব। ভারতে একটি ইয়ার্ডে সাধারণত একটি জাহাজ ভাঙা হয়। তারা যতটা সংখ্যার কথা বলে, আমাদের ১৩টি ইয়ার্ড তার সমতুল্য কাজ করছে। আগে যেখানে আমরা বছরে ৫টা জাহাজ রিসাইকেল করতাম, এখন ২০টা করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছি। আমাদের সক্ষমতা আছে। এক্ষেত্রে সরকার, শিল্প মন্ত্রণালয় ও শ্রম মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা কামনা করেন তিনি।