মাওলানা ওবায়দুল হক শত বছর বেঁচে আছেন তাঁর কর্মে,থাকবে অনন্তকাল।
কাইয়ুম চৌধুরী, সীতাকুণ্ডঃ
আজ ৯ই জুলাই শিক্ষার আলোক বর্তীকা, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক বিশিষ্ঠ শিক্ষানুরাগী ক্ষনজন্মা মহাপুরুষ, সীতাকুণ্ড সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়,সীতাকুণ্ড আলিয়া ( কামিল) মাদরাসা,সীতাকুণ্ড সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়,শেখ পাড়া ওবায়দিয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা মরহুম হযরত মাওলানা ওবায়দুল হক সাহেবের ১০৩তম মৃত্যু বার্ষিকী। তিনি ১৮৫৬ইং সনের ০৮ই জুন সীতাকুণ্ডের বাড়বকুণ্ড মান্দারীটোলা গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। উনার পিতা মরহুম মাওলানা কমর আলী সাহেবের পিতা ফরাজি আন্দোলনের নেতৃত্বের মাধ্যমে খুলনা অঞ্চল থেকে চট্টগ্রাম আসেন। এই মহাপুরুষ প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্তির পর উচ্চ শিক্ষা অর্জনের জন্য বিভিন্ন তথ্য মতে ভারতের নানা স্থানে গমন করেন। ধর্মীয় ও নীতি শাস্ত্রে উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য পূর্ব পাঞ্জাবের চারহিনদ, মুর্সিদাবাদ, শাহরানপুরসহ প্রবৃত্তি স্থানে গমন করেন ও জ্ঞান লাভ করেন। কলকাতা দেওবন আলিয়া মাদ্রাসা থেকে দুটি স্বর্ণপদক সহ আরবি সাহিত্যে উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করেন। মাওলানা সাহেব শিক্ষা জীবন শেষ করে যখন দেশে আসেন তখন সমগ্র ভারতবর্ষে ছিল ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দলোন।মাওলানা ওবায়দুল সাহেব নানা চেতনায় সমৃদ্ধ হয়ে সীতাকুণ্ডের সকল শ্রেণির পেশা ও ধর্মের মানুষকে সাথে নিয়ে নিজেকে শিক্ষা বিস্তারে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি উপলদ্ধি করেছিলেন ব্রিটিশকে কখনো অস্র দিয়ে ঠেকানো যাবে না, তাদেরকে ঠেকাতে হলে শিক্ষার কোন বিকল্প নাই। তিনি আন্তরিকতা ঐকান্তিক নিষ্ঠা ও সততার মধ্য দিয়ে শত প্রতিকুলতাকে উপেক্ষা করে শিক্ষা বিস্তারে কার্যক্রম চালিয়ে যান। ১৮৮৬ সালে সীতাকুণ্ডের প্রাণ কেন্দ্রে একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে প্রথম শিক্ষার আলো প্রজ্বলিত করেন। কিন্তু হিন্দু জমিদারগণ সীতাকুণ্ডের মত পৌরানিক তীর্থ ক্ষেত্রে মুসলমানদের জন্য মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে প্রবল বাধা হয়ে দাড়ায়। মাদ্রাসাটি প্রতিষ্ঠা হওয়ার পরের বছরেই আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। তারুণ্যে উজ্জীবিত মাওলানা ওবায়দুল হক সাহেব কোন বাধাকেই বাধা মনে করতেন না। তিনি নিরুৎসাহিত না হয়ে পুনরায় মাদ্রাসা গৃহটি নির্মাণ করেন। কিন্তু ৪ বছর পর আবারও দুষ্টু চক্র মাদ্রাসা গৃহটি পুড়িয়ে দেয়, এতেও মাওলানা সাহেব দমে যাননি। পাড়ায় পাড়ায় মহল্লায় মহল্লায় ভিক্ষার ঝুলি কাঁধে নিয়ে অর্থ সংগ্রহ করেন এবং পাকা ঘর নির্মাণের কাজ শুরু করেন। মুহাদ্দিস মরহুম হযরত মাওলানা হোসাইন আহম্মদের উক্তি মতে তখণকার সময় কলকাতার একজন মুসলমান ব্যবসায়ী মাদ্রাসা পাকা করণে বড় ধরণের আর্থিক সহযোগিতা করেন। কিন্তু মাওলানা সাহেবকে দমাতে না পেড়ে এবার হিন্দু জমিদারগণ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়ের করেন। মামলার কারণে পাকা দালান নির্মাণ কাজ বেশ কিছুদিন বন্ধ ছিল। অবশেষে মাওলানা সাহেবের দরখাস্তের পরিপ্রেক্ষিতে আদালতের বিচারক সীতাকুণ্ডের মাদ্রাসা মাঠ প্রাঙ্গনে এজলাস বসিয়ে মাদ্রাসার পক্ষে ঐতিহাসিক রায় ঘোষণা করেন, এতে মাওলানা সাহেবেরে মনোবাসনা সফল হয়। ইট-সুরকির গাঁধুনিতে লাল দিঘীর পশ্চিম পাড়ে নির্মিত হয় বর্তমান সীতাকুণ্ড এম.এ কামিল মাদ্রাসা। অসম্প্রদায়িক চেতনার মাওলানা ওবায়দুল হক ইসলামি শিক্ষার পাশাপাশি যুগোপযোগী ইংরেজি শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। ১৯১৩ সালে সীতাকুণ্ড উচ্চ বিদ্যালয় ও বিদ্যালয়ের সাথে একটি সংযুক্ত প্রাথমিক বিদ্যালয় চালু করেন। এই বিদ্যালয়টি বর্তমানে লাল দিঘীর উত্তর পাড়ে সীতাকুণ্ড উন্নয়ন প্রাথমিক বিদ্যালয় হিসাবে পরিচিত। কিন্তু ১৯১৫ সালে সেই দুষ্টু চক্র বিদ্যালয়টি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয় এবং সেই অগ্নিকাণ্ডে সব কিছু জ্বলে পুড়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। এটা ছিল বিদ্যালয়ের ইতিহাসে অত্যান্ত র্মমান্তিক ঘটনা। মাওলানা সাহেবের সঙ্গী সাথীরা হতাশায় স্বপ্ন ভঙ্গের মত হতবিহবল হয়ে পড়ে। কিন্তু মাওলানা সাহেব দমবার পাত্র নন বরং কঠোর শপথ নিলেন এবং সবাইকে আশ্বস্থ করলেন এবার এমন একটি গৃহ নির্মাণ করবেন যেন কোন দুস্কৃতিকারী তা ধ্বংস করতে না পারে। বিদ্যালয়গৃহ যখন দাউ দাউ করে জ্বলছিল ঠিক সেই সময় রেঙ্গুনের ব্যবসায়ী রাজ জামাল সাহেব রেল পথে যাচ্ছিলেন।তিনি মাওলানা সাহেবের স্কুলের দুর্ভাগ্যের কথা শুনে যাত্রা বিরতি করেন এবং মাওলানা সাহেবকে তৎকালীন স্কুলঘর স্থায়ী নির্মাণের জন্য ৫,০০০/- টাকা এবং আসবাবপ্রত্রের জন্য ৭০০/- টাকা অনুদান দেন। এতে সীতাকুণ্ড বাসীর সর্বপ্রকার হতাশা কেটে গেল এবং সবাই দ্বিগুণ উৎসাহে মাওলানা সাহেবকে সহযোগিতায় নেমে পড়লেন। ইহা ছাড়াও সীতাকুণ্ডের মানুষ যার যার সাধ্য মতে মাওলানা সাহেবকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। মাওলানা সাহেব মেয়েদের জন্যও আলাদা শিক্ষা ব্যবস্থার কথা চিন্তা করে সীতাকুণ্ড বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়েরও গোড়া পত্তন করেন। শেখপাড়া ওবায়দিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ও মাওলানা ওবায়দুল হক সাহেব প্রতিষ্ঠা করেন। এইভাবেই শুরু হয় শিক্ষা বিস্তারের অগ্রযাত্রা।মাওলানা সাহেব বহু মাদ্রাসা মক্তব স্কুল প্রতিষ্ঠা ছাড়াও সীতাকুণ্ডের লাল দিঘীর দুপাড়ে দুটি প্রতিষ্ঠান সাফল্যের অমর স্বাক্ষী হয়ে আজীবন দন্ডায়মান থাকবে সীতাকুণ্ড এম.এ কামিল মাদ্রাসা ও সীতাকুণ্ড সরকারি আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়। স্কুল মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার প্রথম দিকে হিন্দু জমিদারেরা বিরুধীতা করলেও পরবর্তীতে মাওলানা সাহেবের আদর্শ সম্পর্কে বুঝতে পেরে সহযোগিতার হাত সম্প্রসারণ করেন। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকল নাগরিক উপলদ্ধি করেন মাওলানা সাহেব একজন শিক্ষানুরাগী ও অসম্প্রদায়ীক চেতনার মানুষ। উনার শিক্ষা সারথী হিসেবে শিক্ষা বিস্তারে উনার পাশে থেকে যারা সহযোগিতা করেছেন মাওলানা জামাল উল্লাহ সাহেব, মাওলানা সৈয়দ ওবাদুর রহমান সহ সীতাকুণ্ডের প্রভাবশালী ব্যক্তিসহ সর্বশ্রেণির মানুষ। অত্র বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসাবে যারা মাওলানা সাহেবকে শিক্ষা বিস্তারে সহযোগিতা করেছেন জাতীয় শিক্ষাবিদ ড. মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ, আব্দুল করিম সাহিত্যবিশারদ, কথা সাহিত্যিক আবুল ফজল, বাবু অর্পনা চরণ দে, পিন্সিপাল নজির আহম্মদ, চট্টলা কবি সাহিত্যিক অহিদুল আলমসহ অনেক দেশ বরণ্য শিক্ষাবিদগণ। ১৯২১ সালের ৯ই জুলাই তারিখে এই মহাপুরুষের তিরোধান হয়। উনার পৌপুত্র হিসাবে পরিবারের পক্ষ থেকে দিদারুল আলম সকলের কাছে দোয়া চাইছেন আল্লাহ যেন উনাকে জান্নাতুল ফেরদাউসের সর্বচ্চো মাকাম নছিব দান করেন, এই কৃতি মহাপুরুষের জন্য সীতাকুণ্ডে একটি স্মৃতিস্মারক হওয়া প্রয়োজন এবং অন্তত প্রতি বছর উনার দুই প্রতিষ্ঠান ও সীতাকুণ্ডের বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন থেকে স্মরণ সভা ও দোয়ার ব্যবস্থা করা পরিবারের পক্ষ থেকে প্রয়োজন বলে অনুভব করেছেন। কারণ গুণীজনকে সম্মানীত করলে গুণীজন সৃষ্টি হয়। এই উপলক্ষে পরিবারের পক্ষ থেকে ৯ জুলাই প্রতিবছরের ন্যায় এবারও সীতাকুণ্ড এম.এ কামিল মাদ্রাসায় খতমে কুরআন, কবর জিয়ারত ও দোয়ার আয়োজন করা হয়।
WWW.DESHYNEWS24.COM/REGISTRATION NO-52472/2024
Leave a Reply